নীলাঞ্জনা ৷গোলগাল মুখশ্রী,শ্যামলা,সুঠাম দেহের অধিকারিণী , উচ্চতা পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি ৷বাংলাদেশের জলহাওয়ায় তার উচ্চতাটা ইর্ষনীয় ৷ ধন কুবের মায়ের পিতৃহারা একমাত্র সন্তান ৷শখের ফটোগ্রাফার আর এডভাঞ্চার প্রিয় মানুষ ৷ আমি তাকে নীলু বলে ডাকতাম ৷ নিলুর সাথে পরিচয়টা বেশ কাকতালীয় ভাবেই ৷বন বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো আমার ছোট বেলার নেশা ৷একটু ছুটি পেলেই বন-বাঁদাড়, পাহাড়-ঝরণায় ঘুরে বেড়ায় আমি ৷সে বার বর্ষায় অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম রেমা-কালেঙ্গা রিজার্ভ ফরেস্টের উদ্দেশ্য ৷ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিরহরিৎ বন ৷ বিশাল আয়তন আর অসংখ্য পশুপাখির সমাহার ৷ ভারতীয় সীমানা ঘেষা এ পাহাড়ী বনাঞ্চলটি শহর থেকে অনেক দুরে ৷ যোগাযোগ ব্যবস্হাও নাজুক ৷ লোকজন খুব কমই আসে এখানে ৷ ঘন জঙ্গল , ধানের ক্ষেত, বনের ভেতর একটা ছোট গ্রাম আর বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটা ক্যাম্প আছে ৷ কংক্রিটের শহর থেকে বের হয়ে এর চেয়ে ভালো সময় কাটানোর জায়গা খুব কমই আছে ৷ একা একা ট্রাকিং করে ফিরছিলাম ৷ হঠাৎ দুটি টেইলের মিলনস্হলে ভুত দেখার মত নিলুর সাথে দেখা ৷ পিঠে ট্রাভেল ব্যাগ, কালো চশমা, হাতে লম্বা লেন্সের একটা ক্যামেরা ৷
— হেই্ মিস্টার ৷ এখানে এসে কারো সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি ৷ আমি নীলাঞ্জনা ৷
বলে হাত বাড়িয়ে দিলো ৷ হাত মিলাতে গিয়ে নিজের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভুতি অনুভব করলাম ৷ আমতা-আমতা করে বললাম ৷
–আমি শ্রাবণ ৷
— হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে গেছি ৷ চার ঘন্টার ট্রাকিং ৬ ঘন্টায় শেষ করলাম ৷ ছবি তোলার অভ্যাস আছে তো তাই ৷আসুন বসে কথা বলি ৷
— হ্যাঁ শিওর ৷
দুজন বনবিভাগের বানানো একটা কংক্রিটের বেঞ্চে বসে আলাপ জুড়ে দিলাম ৷ মুলত আজকের ট্রাকিং নিয়েই আলোচনা ৷ তখন পড়ন্ত বিকাল ৷ রেইন ফরেস্টে রাত নামে দ্রুত ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা হয়ে এলো ৷ নীলাঞ্জনা কে জিজ্ঞেস করলাম
— রাতে থাকবেন কোথায় ?
— হবিগঞ্জে অথবা শ্রীমঙ্গলে গিয়ে থাকতে হবে ৷ এখানে তো থাকার ব্যবস্থা নেই ৷
— কিন্তু এখন তো সন্ধ্যা লেগে গেছে ৷ ফেরার সিএনজি পাবেন না ৷ পাঁচ টার পরে সিএনজি পাওয়া যায় না এখান থেকে ৷ যেতে হলে তো ৭/৮ কিলোমিটার হাটতে হবে ৷
নিলুর চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখতে পেলাম ৷
— তাহলে এখন উপায় ( নিলু)
কন্ঠে উদ্বিগ্নতা ছড়ানো ৷
–আমি এখানের বাংলোটা ভাড়া নিয়েছি দুইটি রুম আছে ৷ চাইলে একরুম আপনি ব্যবহার করতে পারেন ৷ ( আমি)
— কিন্তু খাবো কি ? ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে ৷
— বাংলোর কেয়ার টেকারকে বলেছি আমার জন্য রান্না করতে ৷ ভালো কিছু তো পাওয়া যায় না এখানে ৷ গ্রাম থেকে দেশী মুরগী কিনে ঝোল করবে আর মোটা চালের ভাত ৷
— ওয়াও ! অসাধারণ ৷ তাহলে আজ থাকছি আপনার সাথে ৷ কিন্তু মাকে জানাই কি করে ? এখানে যে নেটওয়ার্ক নেই ৷
–বাংলোতে হালকা নেটওয়ার্ক পাবে ৷ ওখানে এন্টেনার ব্যবস্থা আছে ৷
— অহ আচ্ছা ৷ তাহলে চলুন যাই ৷
নিলুর মুখ থেকে দুচিন্তা আর উদ্বিগ্নতা দূর হয়েছে ৷দারুণ দেখতে মেয়েটা ৷ আমার হৃদয়ের এন্টেনায় অন্যরকম একটা ফিকোয়েন্সি অনুভব করলাম ৷ সন্ধ্যার পর পরই খাবার নিয়ে আসলো বাংলোর কেয়ারটেকার জামসেদ ৷ নিলুকে দেখে যেন ভুত দেখলো ৷
— স্যার আপনি বাংলো ভাড়া নিয়েছেন কিন্তু অহন লগে একটা মাইয়া মানুষ ! এইডা তো বিট অফিসার জানলে আমার চাকরি খাইয়া দিবো ৷ (জামসেদ)
নিলুর চেহারায় আবার চিন্তা আর উদ্বিগ্নতা ফুটে উঠলো ৷ আমি ধমক দিয়ে বললাম
— থামো ৷ তোমাকে বলেছিলাম না সন্ধ্যায় একটা সারপ্রাইজ পাবে ?
— জি স্যার ৷ (আমি)
— এটা তোমার ভাবি ৷ বাড়ি থেকে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলো একাই আসতে পারবে ৷ আমার চেয়ে দুই ঘন্টা আগে বের হয়েছিল ৷ এসেছেও দু ঘন্টা আগে ৷ তোমাকে বলেছিলাম বেশি করে খাবার আনতে এনেছো ?
— জি স্যার ৷ আমি এখন আসছি স্যার ৷
— সকালের নাস্তাটা একটু আগে আগে বের হবো ৷
–জি আচ্ছা স্যার ৷ স্লাইকুম ৷
নিলু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে ৷ বললাম
–সরি একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো ৷
— না না ঠিক আছে ৷ আমি ভাবছি আপনি কত সুন্দর করে সাজিয়ে মিথ্যা বলতে পারেন ৷ দারুণ উপস্থিত বুদ্ধি আপনার ৷
— না মানে এটা ছাড়া তো উপায় ছিলো না ৷
— হুমম বুঝেছি ৷ কিন্তু ওর সারপ্রাইজ কি ছিলো ?
একগাল হেসে বললাম
— একশো টাকা বকশিস ৷ কিন্তু সেটা আর বেচারার পাওয়া হলো না ৷ যাক যাবার সময় দিবো ৷ এখন গোসল করে ফ্রেস হয়ে নেন ৷ খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে ৷
গোসল, ডিনার শেষ করে দুজন আড্ডায় বসলাম ৷ দারুণ গানের গলা নিলু আর আমার কবিতা জমিয়ে আড্ডা হলো ৷ বাইরে ঝিঁঝিঁপোকা, শেয়াল আর নিশাচর পাখিরা বাদ্য বাজাচ্ছে ৷ গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে আছে ৷ জানালা দিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস আসছে ৷ জোনাকি পোকারা আলোকিত করে আছে ঝোপঝাঁড় ৷ বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা হলো ৷ হঠাৎ একটু দূরে কয়েকটা হরিণ ডেকে উঠলো , বানরেরা কিচিরমিচির করে উঠলো ৷ একটু ভীত হয়ে পড়লো নিল ৷ বললাম
— বেশ রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পড়ুন ৷ আমি পাশের রুমে আছি ৷ দুই রুমের মাঝের দরজাটা আপনি ভেতর থেকে আটকে দিন ৷
বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে আছি ৷ চোখের সামনে শুধু ওর মুখটা ভেসে উঠছে ৷ কাঁধ বরাবর ঘন চুল , বিলোল আঁখিযুগলের চাহনী, কানে বাজছে মনোহরণী সুর ৷ হঠাৎ মাঝের দরজটা খোলার শব্দ পেলাম ৷ কান খাঁড়া করে রাখলাম শুনেছি এভাবে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই আশ্রয় দাতার সর্বনাশ করে , আমিও কি তবে ? তখন ই দরজা থেকে নিলুর গলার স্বর শুনতে পেলাম ৷
— শ্রাবণ ঘুমিয়েছেন ? আমার ঘুম আসছে না, ভয় করছে ৷ মাঝের দরজাটা খোলা রাখি ?
— হ্যাঁ অবশ্যই ৷ যদি আপনি সমস্যা মনে না করেন ৷
আর কোন কথা শুনতে পেলাম না ৷ নিলুকে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম ৷ ঘুম ভাঙলো তখন সাড়ে সাতটা বাজে ৷ দেখলাম টেবিলটা সুন্দর করে সাজানো ৷ সিগারেটের ছাইদানিটা পরিস্কার ৷ ঘরটা তাজা ফুলের মিস্টি গন্ধে ৷ টেবিলের ফুলদানীতে তাজা বুনো ফুল শোভা পাচ্ছে ৷ মাঝের দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম নিলু টেবিলে বসে কিছু লিখছে ৷ উঠে ওই রুমে গেলাম ৷
— শুভ সকাল ৷ বেশ সকাল সকাল উঠেছেন মনে হচ্ছে ? জামসেদ এসেছিল ?
শুভ সকাল ৷ নাহ আসেনি ৷
— তাহলে এসব কে করলো ?
— আমি ৷
বলে হাসতে শুরু করলো নিলু ৷
–পছন্দ হয়নি ?
–অবশ্যই হয়েছে ৷
–ভালো ৷ একটা কথা বলবো ভাবছি ৷
–বলুন ৷
–আপনার সাথে আরো দুদিন থাকতে চাই এখানে ৷ তারপর একসাথে ঢাকায় ফিরবো ৷ আসলে এতো বড় আর সুন্দর বন কি একদিনে দেখে শেষ করা যায় ?
— থাকুন না ৷ আমি আছি আরো দুই দিন ৷
সকালের নাস্তা সেরে বেড়িয়ে পড়লাম ৷ সঙ্গে শুকনো খাবার আর পানি ৷ সারাদিন ঘুরলাম ৷ অসাধারণ ছবি তুলে নিলু ৷ গল্প আড্ডা আর ঘুরাঘুরিতে শেষ হলো দিন ৷ রাতে আবার যথারীতি আড্ডা ৷ দুদিনের পরিচয়ে মানুষ এতো কাছের হতে পারে ! তৃতীয় দিন দুপুরে বের হয়ে পড়লাম ঢাকার উদ্দেশ্য ৷ স্থির হয়েছিল ট্রেনে ফিরবো ঢাকা ৷ শায়েস্তাগঞ্জে এসে দেখলাম সন্ধ্যার ট্রেন আজ আসবে না ৷ পরের ট্রেন রাত একটায় ৷ প্লাটফর্মে বসে আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম বাকি সময়টা ৷ এসময় নিলু তার পরিচয় বললো ৷ শিল্পপতি মায়ের একমাত্র সন্তান সে ৷ খুব ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছে ৷ মা-ই তার কাছে বাবা-মা সব ৷ সেলফোন নং বিনিময় হলো ৷ যথা সময়ে ট্রেন আসলো ৷ ভোরে ঢাকায় পৌঁছালাম ৷ পরদিন থেকে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কিন্তু ভেতরটা শুন্য শুন্য লাগছে ৷ কি হলো আমার ? হৃদয়ের সকল প্রকোষ্ঠ জুড়ে কেবল নিলু ৷ বৃহস্পতিবার বিকালে হঠাৎ নিলুর ফোন ৷
–কাল তো ছুটি ৷ (নিলু)
–জি কাল ছুটি ৷
— কি প্লান করলেন ৷
— নাহ কোন প্লান করিনি ৷
— চলুন না কাল পানাম নগরী থেকে ঘুরে আসি ৷ আমি সকাল সাতটায় উত্তরায় ” সি শেল” এর সামনে অপেক্ষা করবো ৷
বলেই লাইন কেটে দিলো ৷ যদিও টানা কাজের চাপে ঘুমানোর দরকার ছিল কিন্তু নিলুর ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই ৷ সকালে বের হয়ে পড়লাম একটু আগেই ৷ “সি শেল”এর সামনে আসতেই দেখলাম একটি RAV-4 গাড়ীর সামনে দাড়িয়ে আছে নিলু ৷ আজ তাকে মায়াবী সুন্দরী লাগছে ৷ গাড়ীর সামনে বসতে বলে নিজে বসে পড়লো ড্রাইভিং সিটে ৷সারাদিন ঘুরাঘুরি করে ফিরে এলাম ৷ নিলু আরো জেঁকে বসেছে আমার হৃদয়ে ৷ ভাবনার পাতাগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে ৷ তারপর থেকে প্রতিটি ছুটির দিন ঘুরতে শুরু করলাম ৷ নিলু একদিন বলে দিলো সেও আমাকেই চায় ৷ যেন সাওয়ালের চাঁদ হাতে পেলাম ৷ মাঝে মাঝেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি ৷ বন,সাগর, ঝরনা ,পাহাড়,নদী থেকে কফিশপ বাদ যান না কোন কিছু ৷ নিজেদের নিজস্ব সত্তাকে বিলীন করে দুজন দুজনার হয়ে গেছি ৷ দুজনে মিলে তৈরী হয়েছে নতুন সত্তা ৷হঠাৎ এক বৃহস্পতিবারে নিলুর ফোন থেকে ভেসে এলো না সেই চেনা কণ্ঠটি ” কাল তো ছুটি কি প্লান ? ” ৷ আমি ফোন করবার চেষ্টা করলাম আনরিচএবল ৷ তারপর অসংখ্য বৃহস্পতিবার , অসংখ্য ছুটি গত হয়েছে নিলুর ফোন থেকে কল আসেনি ৷ আমিও পায়নি তাকে ফোনে ৷ অথচ আজও বৃহস্পতিবার অথবা ছুটির দিনে অপেক্ষায় থাকি ৷ নিলুর ফেরার অপেক্ষায় ৷
You must be logged in to post a comment.